আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে প্রবাসী নারী কর্মীদের
নিজস্ব প্রতিবেদক জাগরণ ডট নিউজ
আপডেট: মে ১, ২০১৯ ১১:৪৬
নাটোরের লালপুর উপজেলার আবদুর রহিমের মেয়ে শাহনাজ বেগম (৩৫)। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরানোর স্বপ্ন নিয়ে ২০১৮ সালের আগস্টে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। সচ্ছলতা তো ফেরাতে পারেননি, বরং সেখানে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বেছে নেন আত্মহননের পথ। গত জানুয়ারিতে সৌদি আরব থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেরত আসে শাহনাজের মরদেহ।
শুধু শাহনাজই নন, বিদেশে কাজ করতে গিয়ে গত তিন বছরে এমন আরো ৪৪ জন বাংলাদেশী নারী শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। যদিও এ পরিসংখ্যান কেবল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেরত আসা মরদেহের তথ্য। এর বাইরেও আরো অনেক নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মরদেহ এখনো দেশে এসে পৌঁছেনি। আবার অনেক পরিবার মৃত্যুর পর মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে চায় না। ফলে বিদেশে নারী শ্রমিকের আত্মহত্যার বিষয়ে সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশী নারী শ্রমিকরা মূলত মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচ দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, লেবানন ও জর্ডানেই সবচেয়ে বেশি গেছেন। এ কারণে এসব দেশ থেকে মরদেহ ফেরত আসার সংখ্যাও বেশি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে মরদেহ ফেরত আসা নারী কর্মীর মধ্যে মাত্র একজনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২। গত বছর তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ জনে। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) মরদেহ ফেরত আসা নারী কর্মীর মধ্যে আটজনের মৃত্যুর কারণ ছিল আত্মহত্যা।
নারী শ্রমিকদের আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাস সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল গত বছর। ওই বছরের ১ জানুয়ারি সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাসের শেল্টার হোমে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করেন কল্পনা নামের এক নারী কর্মী। ঘটনার পর সৌদি পুলিশ শেল্টার হোম থেকে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করে হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। প্রাথমিক তদন্তে ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন বলে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানানো হয়। আত্মহত্যার ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী নারী কর্মীদের মানসিক দুরবস্থার বিষয়টি সামনে চলে আসে। এরপর শেল্টার হোমে অবস্থানরত নারীদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোয় তত্পর হয়ে ওঠে সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়।
ভাগ্য ফেরাতে বিদেশে গিয়ে নারী শ্রমিকরা আত্মহত্যা করেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক ড. সি আর আবরারের সঙ্গে। তিনি বলেন, অধিকাংশ নারী শ্রমিকই বিদেশে গিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজের পরিবেশ পাচ্ছেন না, যা তাদের সবসময় মানসিক চাপের মধ্যে রাখে। এটিই অস্বাভাবিক মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। নারী শ্রমিকের অস্বাভাবিক মৃত্যু কেন বাড়ছে, সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। আর যেসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে দুর্ঘটনা, স্ট্রোক বা স্বাভাবিক বলা হচ্ছে, সেগুলো কতটা ঠিক, তাও কিন্তু বিবেচনা করতে হবে। কারণ বিমানবন্দরে মরদেহ আসার পর স্বজনরা কিন্তু প্রকৃত কারণ খোঁজার চেয়ে তাড়াতাড়ি দাফন করার দিকেই বেশি গুরুত্ব দেন। ফলে অনেক সময়ই প্রকৃত কারণ জানা যায় না।
শাহনাজের ভাই গুলজার বলেন, স্বামী অন্ধ হওয়ায় পরিবারে আর্থিক অসচ্ছলতা ছিল শাহনাজের। এক ছেলে ও এক মেয়ের মা শাহনাজ মূলত পরিবারকে অর্থের জোগান দিতেই সৌদি আরবে গিয়েছিল। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সেখানে কী এমন ঘটে যে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে হয় তাকে?
মূলত ২০১৫ সালেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় গৃহকর্মী হিসেবে যেতে শুরু করেন বাংলাদেশী নারী কর্মীরা। ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমানো এসব নারীর স্বপ্নভঙ্গ ঘটে সেখানে পৌঁছার পরই। কম পারিশ্রমিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক না পাওয়ার মতো ঘটনা প্রায়ই মোকাবেলা করতে হয়েছে তাদের। অনেকেরই কপালে জুটেছে নির্মম শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন। ফলে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে অনেকেই সেসব দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের শেল্টার হোমে আশ্রয় নিয়েছেন।
শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফেরত আসার তালিকা অনেক লম্বা। নানা জটিলতায় আটকে গিয়ে দেশে ফিরতে পারছেন না, এমন নারীর সংখ্যাও কম না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন পার করছেন তারা। যার পরিপ্রেক্ষিতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনাগুলো ঘটছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ জন করে নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। একই সঙ্গে সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দায় সেফহোমগুলোয় গড়ে ২০০ জন করে নারী শ্রমিক আশ্রয় নিয়েছেন। আর গত দু-তিন বছরে অন্তত পাঁচ হাজার নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। এই নারীদের একটি বড় অংশ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৩ হাজার ৩৫৩টি মরদেহ দেশে এসেছে। এর মধ্যে নারী কর্মীর মরদেহ ছিল ১১২টি, যার মধ্যে ২৩ জনের মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। এছাড়া দুর্ঘটনায় মারা যান ১৫ জন, স্ট্রোকে ৪৩ জন, স্বাভাবিক মৃত্যু হয় ১৬ জনের এবং অন্যান্য কারণে মৃত্যু হয় ১৫ জন নারী কর্মীর। আর ২০১৭ সালে মরদেহ ফেরত আসা ১০২ জন নারী কর্মীর মধ্যে আত্মহত্যা করেন ১২ জন, দুর্ঘটনায় ১৯ জন, স্ট্রোকে ৩৭ জন, স্বাভাবিক মৃত্যু হয় ২২ জনের। অন্যান্য কারণে মৃত্যু হয় ১২ জন নারী কর্মীর। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মরদেহ ফেরত আসা নারী কর্মীর মধ্যে আত্মহত্যা করেন আটজন, দুর্ঘটনায় মারা যান চারজন, স্ট্রোকে মারা যান ১০ জন এবং স্বাভাবিক মৃত্যু হয় একজনের।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার পর নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসার হার বাড়ার কারণে প্রবাসগমন থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন বাংলাদেশী নারী কর্মীরা। গত বছর বাংলাদেশ থেকে মোট নারী শ্রমিক রফতানি হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ জন। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫। সে হিসেবে এক বছরেই নারী শ্রমিক রফতানি কমেছে ১৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
আর গত দুই বছরের জনশক্তি রফতানি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে প্রতি মাসে গড়ে ১০ হাজার ১৬০ জন নারী কর্মী বিদেশ গেছেন। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এ সংখ্যা কমে হয়েছে ৮ হাজার ৪৭৪। সে হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ৬৮৫ জন নারী শ্রমিক কম গেছেন গত বছর।